সরকার বলছে প্রাণভিক্ষা চেয়েছে, পরিবার বলছে চায়নি।



    একাত্তরে মানবতাবিরোধী অপরাধে বিএনপির নেতা সালাউদ্দিন কাদের (সাকা) চৌধুরী ও জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মোহাম্মাদ মুজাহিদ গতকাল শনিবার প্রাণভিক্ষা চেয়ে রাষ্ট্রপতির কাছে আবেদন করেন বলে কারা কর্তৃপক্ষ ও সরকারের পক্ষ থেকে জানানো হয়। তবে তাঁদের পরিবার ও দল এ কথা মানেনি।
    গতকাল রাতে সাকা চৌধুরীর সঙ্গে শেষ দেখা করে বেরোনোর পর তাঁর ছেলে হুম্মাম কাদের চৌধুরী বলেন, তাঁর বাবা রাষ্ট্রপতির কাছে প্রাণভিক্ষা চেয়ে আবেদন করেননি। শেষ দেখা করে মুজাহিদের ছেলে আলী আহমেদ মাবরুরও সাংবাদিকদের বলেন, তাঁর বাবা প্রাণভিক্ষা চাননি। সরকার মিথ্যাচার করছে।
    গত বুধবার সাকা চৌধুরী ও মুজাহিদের করা ফাঁসির রায় পুনর্বিবেচনার (রিভিউ) আবেদন খারিজ করে দেন সর্বোচ্চ আদালত। গত বৃহস্পতিবার সেই রায়ের অনুলিপি কারাগারে পৌঁছায় এবং বৃহস্পতিবার রাতেই সাকা চৌধুরী ও মুজাহিদকে রায় পড়ে শোনানো হয় বলে কারাগারের দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা জানিয়েছেন। রায়ের অনুলিপি কারাগারে যাওয়ার পর থেকেই ‘তাঁরা রাষ্ট্রপতির কাছে প্রাণভিক্ষা চাইবেন কি না’ তা আলোচিত হচ্ছিল। গত শুক্রবার কারা কর্মকর্তারা জানান, ওই দিন একাধিকবার তাঁদের কাছে প্রাণভিক্ষার বিষয়ে জানতে চাওয়া হয়, কিন্তু তাঁরা কোনো সিদ্ধান্ত দেননি।
    গতকাল সকাল থেকেই সংবাদ কর্মীরা পুরান ঢাকার নাজিমউদ্দিন সড়কে কেন্দ্রীয় কারাগারের সামনে ভিড় জমান। তবে কারাগারের ভেতরে কী হচ্ছে, সে বিষয়ে কারা কর্তৃপক্ষের কেউই আনুষ্ঠানিকভাবে দিনভর কিছু বলেননি। মুঠোফোনে সংগৃহীত ভাসা ভাসা খবরই ছিল সবার ভরসা।
    সকাল ৯টা ৫০ মিনিটে দুজন ম্যাজিস্ট্রেটকে ভেতরে ঢুকতে দেখা যায়। কারা সূত্রগুলো জানায়, ওই ম্যাজিস্ট্রেটদের উপস্থিতিতে মুজাহিদ ও সাকা প্রাণভিক্ষার আবেদন করবেন। এরপর বেলা সাড়ে তিনটার দিকে ওই ম্যাজিস্ট্রেটরা কারাগার থেকে বের হয়ে যান। তবে কেউই গণমাধ্যমের সঙ্গে কোনো কথা বলেননি।
    সাকা ও মুজাহিদ প্রাণভিক্ষার আবেদন করবেন কি না বা করেছেন কি না, সে প্রশ্নটিরই উত্তর খুঁজে ফিরছিলেন গণমাধ্যমকর্মীরা। তবে কোনো সরকারি কর্মকর্তাকে এর জবাব দেওয়ার জন্য পাওয়া যায়নি। বেশির ভাগের ফোনই বন্ধ ছিল। বেলা একটার পর থেকে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের বিভিন্ন সূত্র থেকে নাম প্রকাশ না করার সূত্রে গণমাধ্যমকর্মীদের সঙ্গে যোগাযোগ করে বলা হয়, তাঁরা ১৯৭১ সালে তাঁদের কৃতকর্মের জন্য দোষ স্বীকার এবং নিঃশর্ত ক্ষমা প্রার্থনা করে রাষ্ট্রপতির কাছে প্রাণভিক্ষার আবেদন করেছেন। অনামা সূত্রের বরাত দিয়ে বিভিন্ন গণমাধ্যম তাঁরা প্রাণভিক্ষা চেয়েছেন বলে সংবাদ প্রকাশ করে।
    ঘণ্টা দেড়েক এ রকম পরিস্থিতির পর বেলা তিনটার পরে প্রথমে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক এবং পরে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল প্রাণভিক্ষা চাওয়ার বিষয়টি গণমাধ্যমকে জানান। তখন আইনমন্ত্রী প্রথম আলোকে বলেছিলেন, ‘আমি জেনেছি, সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী ও আলী আহসান মোহাম্মাদ মুজাহিদ প্রাণভিক্ষার আবেদন করেছেন। তবে এখনো তা আমার কাছে আসেনি।’ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমিও বিষয়টি শুনেছি। যেহেতু আমি বাসায়, এ ব্যাপারটা এখনো নিশ্চিত নই।’ এরপর বিকেল পৌনে চারটার দিকে স্বরাষ্ট্রসচিব মোজাম্মেল হক প্রথম আলোকে বলেন, সাকা চৌধুরী ও মুজাহিদের প্রাণভিক্ষার আবেদন তাঁর হাতে এসেছে।
    গতকাল শনিবারের সাপ্তাহিক ছুটি সত্ত্বেও আইন মন্ত্রণালয় ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় খোলা ছিল। আইন মন্ত্রণালয়ের সূত্র জানায়, ওই দুজনের আবেদন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে আইন মন্ত্রণালয়ে আসে। পরে আইন মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা আবেদনের আইনি বিষয় যাচাই করে সন্ধ্যায় এ-সংক্রান্ত ফাইল নিয়ে যান আইনমন্ত্রীর বাসায়।
    সন্ধ্যায় আইনসচিব আবু সালেহ শেখ মো. জহিরুল হক বলেন, তাঁরা আবেদন দুটি পেয়েছেন। এখন এর ওপর কাজ করছেন।
    গতকাল সন্ধ্যা সাড়ে সাতটার দিকে গুলশানের বাসভবনে আইনমন্ত্রী বলেন, বাংলাদেশের সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৪৯-এ মহামান্য রাষ্ট্রপতির যে ক্ষমা করার ক্ষমতা, সেই ক্ষমতা প্রয়োগের জন্য তাঁরা আবেদন করেছেন। এই আবেদনের মধ্যে তাঁরা কী লিখেছেন আর আইন মন্ত্রণালয় তাতে কী মতামত দিয়েছে, সেটি তিনি বলেননি। তিনি জানান, আবেদনটি রাষ্ট্রপতির বিবেচনার জন্য তাঁর কাছে পাঠানো হয়েছে।
    গতকাল রাত সাড়ে নয়টার দিকে জানা যায়, রাষ্ট্রপতি তাঁদের প্রাণভিক্ষার আবেদন নাকচ করেছেন।
    প্রাণভিক্ষার খবর বিশ্বাস করে না সাকার পরিবার: গতকাল গুলশানে বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় বলেন, সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী প্রাণভিক্ষা চাইবেন না। ওই সংবাদ সম্মেলনে সাকা চৌধুরীর স্ত্রী ফারহাত কাদের চৌধুরী স্বাক্ষরিত লিখিত বক্তব্য পড়ে শোনান তিনি। এ সময় ফারহাত ও সাকার ছেলে হুম্মাম কাদের চৌধুরীও উপস্থিত ছিলেন।
    লিখিত বক্তব্যে বলা হয়, সাকা চৌধুরী রাষ্ট্রপতির কাছে আবেদন করেছেন, তিনি যেন এটিকে ত্রুটিপূর্ণ বিচার (মিস ট্রায়াল) হিসেবে ঘোষণা দেন। সাকা চৌধুরী অনুরোধ করেছেন, যেন তাঁর সাফাই সাক্ষীর ওপর নিষেধাজ্ঞা তুলে নিয়ে আদালতে তাঁদের সাক্ষ্য প্রদানের সুযোগ দেওয়া হয়। তাঁর প্রামাণিক দলিল গ্রহণ এবং সত্যতা যাচাই করা হয়। সাকা চৌধুরী রাষ্ট্রপতিকে স্মরণ করিয়ে দিতে চান যে তিনি বাংলাদেশের সংবিধানের অভিভাবক। আইনের রক্ষক হিসেবে তিনি অবশ্যই বুঝতে পারবেন, এখানে ন্যক্কারজনকভাবে আইনের অপব্যবহার করা হচ্ছে। এই অবিচারের প্রতিকার করার জন্য মাননীয় রাষ্ট্রপতি প্রতিজ্ঞাবদ্ধ।
    সেখানে ফারহাত কাদের বলেন, এটা ত্রুটিপূর্ণ বিচার হয়েছে। এ বিষয়টিই তাঁরা আবেদনের মাধ্যমে তুলে ধরবেন।
    এরপর গতকাল বিকেলে রাষ্ট্রপতির কাছে জমা দেওয়ার জন্য একটি আবেদন (পিটিশন) নিয়ে বঙ্গভবনে যান হুম্মাম কাদের চৌধুরী। তবে তিনি আবেদনটি জমা দিতে পারেননি। বিকেল সোয়া চারটার দিকে হুম্মাম বঙ্গভবনের কাছে গেলে তাঁর গাড়ি আটকে দেওয়া হয়। বঙ্গভবনের প্রধান ফটকে দায়িত্বে থাকা কর্মকর্তাদের কক্ষে কিছুক্ষণ অবস্থানের পর ফিরে আসেন হুম্মাম। এরপরে তিনি সাংবাদিকদের বলেন, বঙ্গভবন সরাসরি কোনো আবেদন গ্রহণ করে না বলে তাঁকে জানানো হয়েছে।
    সাকা চৌধুরীর প্রাণভিক্ষার আবেদন সম্পর্কে জানতে চাইলে হুম্মাম বলেন, ‘আমরা এটা বিশ্বাস করি না। বাবার মুখ থেকে না শোনা পর্যন্ত এটা বিশ্বাস করতে পারি না। কারণ, সর্বশেষ (বৃহস্পতিবার) সাক্ষাতে বাবা বলেছিলেন, আইনজীবীর সঙ্গে বলে সিদ্ধান্ত নেবেন। কিন্তু এর মধ্যে তো আইনজীবীরা দেখা করতে পারেননি।’
    রাতে বাবার সঙ্গে শেষ দেখার পরে সাকা চৌধুরীকে উদ্ধৃত করে হুম্মাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমার বাবা বলেছেন, সরকার নির্বাচনে আমাকে (সাকা) হারাতে পারেনি। তাই আমার জান নিয়ে নিচ্ছে।’
    রাষ্ট্রপতির কাছে তাঁর বাবা ক্ষমা প্রার্থনা করেছেন কি না, জানতে চাইলে হুম্মাম বলেন, ‘আমার বাবা আমাকে বলেছেন, এ সরকারের আমলে কত কাগজ বের হচ্ছে। এ রকম বাজে কথা (প্রাণভিক্ষা) কে বলেছে?’ তিনি প্রাণভিক্ষা চাননি বলে দাবি করেছেন হুম্মাম।
    সবই ‘গুজব’ বলল মুজাহিদের পরিবার: রাতে শেষ দেখা করে আলী আহমেদ মাবরুর বলেন, ‘আমার বাবা প্রাণভিক্ষা চাননি। এরা আগে মিথ্যাচার করেছে, এখনো করছে।’
    এর আগে আলী আহসান মোহাম্মাদ মুজাহিদ প্রাণভিক্ষার আবেদন করেছেন বলে সরকারের পক্ষ থেকে যে কথা বলা হয়েছে, তা গুজব বলে উড়িয়ে দেন তাঁর পরিবারের সদস্যরা। গতকাল সন্ধ্যায় মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে তাঁর মেজো ছেলে আলী আহাম্মদ মাবরুর প্রথম আলোকে বলেন, দুজন ম্যাজিস্ট্রেট যে বাবার সঙ্গে দেখা করে বের হলেন, তাঁরাও কিন্তু গণমাধ্যমের সামনে প্রাণভিক্ষার বিষয়ে কিছু বলেননি। দুই দিন ধরে আবেদন করা সত্ত্বেও তাঁর বাবার সঙ্গে আইনজীবীদের দেখা করতে দেওয়া হয়নি। তা ছাড়া এ বিষয়ে তাঁর বাবার সঙ্গে তাঁদের পরিবারের কেউ কথা বলতে পারেননি।
    তাঁর বাবা প্রাণভিক্ষার আবেদন করেছেন বলে গতকাল দুপুর থেকে কারা কর্তৃপক্ষের বরাত দিয়ে গণমাধ্যমে যে খবর প্রচারিত হচ্ছে, সে বিষয়ে মাবরুর বলেন, গণমাধ্যমগুলো ওই তথ্যের তথ্যসূত্র হিসেবে শুধু কারা কর্তৃপক্ষের বরাত দিচ্ছে। কিন্তু কারাগারের কোন কর্মকর্তা এ কথা বলছেন, তা কোনো গণমাধ্যই প্রকাশ করেনি। তিনি বলেন, সব মিলিয়ে আলী আহসান মোহাম্মাদ মুজাহিদ রাষ্ট্রপতির কাছে প্রাণভিক্ষা চেয়েছেন বলে যে খবর ছড়ানো হচ্ছে, তা গ্রহণযোগ্য নয়। তাঁদের পরিবার ও আইনজীবীদের সঙ্গে দেখা করতে না দিয়ে কৌশলে এসব কথা ছড়ানো হচ্ছে। এর আগে গতকাল দুপুরে সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতি মিলনায়তনে সংবাদ সম্মেলন করে মুজাহিদের পরিবার জানায়, প্রাণভিক্ষার আবেদনের বিষয়ে পরিবারের সঙ্গে সর্বশেষ সাক্ষাতে কোনো কথা বলেননি মুজাহিদ।
    এদিকে গতকাল এক বিবৃতিতে জামায়াতে ইসলামীর ভারপ্রাপ্ত সেক্রেটারি জেনারেল শফিকুর রহমান বলেছেন, বিভিন্ন গণমাধ্যমে কারা অধিদপ্তরের বরাত দিয়ে মুজাহিদের প্রাণভিক্ষার আবেদনের যে খবর প্রচারিত হচ্ছে, তা অসত্য ও বিভ্রান্তিকর।
    মুজাহিদের পরিবারের দাবি বিভ্রান্তিকর—অ্যাটর্নি জেনারেল: মৃত্যুদণ্ডের কাজ স্থগিত রেখে অন্য মামলার কাজ চালিয়ে যাওয়ার বিষয়ে মুজাহিদের পরিবারের দাবিকে অযৌক্তিক বলেছেন অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম। গতকাল সুপ্রিম কোর্টে নিজ কার্যালয়ে সংক্ষিপ্ত সংবাদ ব্রিফিংয়ে তিনি বলেন, মানুষকে বিভ্রান্ত করার জন্য তাঁরা এই দাবি করেছেন।
    অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, কোনো ব্যক্তির নামে একাধিক মামলা থাকলে এর কোনো একটিতে তাঁর মৃত্যুদণ্ড হলে অন্য মামলাগুলো অকার্যকর হয়ে যায়। এই পর্যায়ে সংবিধান অনুযায়ী মুজাহিদ রাষ্ট্রপতির কাছে ক্ষমাভিক্ষার আবেদন ছাড়া অন্য কোনো আবেদন করতে পারবেন না। রাষ্ট্রপতির পদ এমন না যে আসামি চাইলেই তাঁর সঙ্গে চিঠিপত্র লেনদেন করবেন। তবে উনি চাইলে নিকটাত্মীয়দের কাছে চিঠিপত্র পাঠাতে পারেন।
    ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলা মামলা সম্পর্কে মাহবুবে আলম বলেন, একজন ব্যক্তির বিরুদ্ধে পাঁচটি মামলা থাকলে এর একটিতে তাঁর মৃত্যুদণ্ড হলে অন্য চারটি মামলা নিষ্পত্তির জন্য মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হবে না, আইন তা বলে না। রাষ্ট্র অভিযোগ আনলেই আলী আহসান মোহাম্মাদ মুজাহিদ দায়ী হয়ে যাবেন না। আদালতের রায়ে তাঁকে দায়ী ঘোষণা করতে হবে। কিন্তু এই মামলা বিচারাধীন। সুতরাং অন্য মামলায় তাঁর মৃত্যুদণ্ড হয়ে গেলে এই মামলাটি অকার্যকর হয়ে যাবে। কারণ, আদালত মৃত ব্যক্তির বিরুদ্ধে কোনো সাক্ষ্য গ্রহণ করেন না বা মন্তব্য করেন না। কারণ, উনি জীবিত নন। উনি সবকিছুর ঊর্ধ্বে।
    এই পর্যায়ে আইনজীবীরা দেখা করতে পারেন কি না প্রশ্নের জবাবে অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, আইনি প্রক্রিয়া চলমান থাকলে দেখা করার অধিকার থাকে। কিন্তু এখন আর কোনো ধরনের আইনি প্রক্রিয়া বাকি নেই।
    সুত্রঃ প্রথম আলো।

    *

    Post a Comment (0)
    Previous Post Next Post