পদ্মা সেতু - পদ্মা সেতুর আদ্যোপান্ত—১


     ‘সর্বনাশা পদ্মা নদী, তোর কাছে শুধাই/ বল আমারে   তোর কি রে আর কূল কিনারা নাই...।’

    আবদুল লতিফের লেখা ও সুর করা এই গান গেয়েছিলেন আবদুল আলীম। পল্লিগীতিটিতে ফুটে উঠেছে প্রমত্ত পদ্মা নদীর বিশালত্ব ও ভয়ংকর রূপ। একালে উজানে পদ্মা কিছুটা বিগতযৌবনা। পলি জমেছে, চর পড়েছে, সংকীর্ণ হয়েছে স্রোতোধারা। তবে রাজবাড়ীর গোয়ালন্দ থেকে ভাটির দিকে পদ্মা এখনো খরস্রোতা ও গভীর।


    দেশের মধ্যভাগ ও পূর্বাঞ্চলের সঙ্গে দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের নিরবচ্ছিন্ন যোগাযোগে বড় বাধা পদ্মা পারাপার। যানবাহন পারাপারের মাধ্যম ফেরি। মানুষ পারাপারের মাধ্যম লঞ্চ, ট্রলার, স্পিডবোট অথবা নৌকা। বর্ষায় পদ্মা যখন ভয়ংকর রূপ নেয়, তখন ছোট নৌযানে নদীটি পাড়ি দেওয়া অনেকটা প্রাণ হাতে নেওয়ার মতো। আর ফেরিঘাটে সারা বছর মানুষকে ভুগিয়েছে যানবাহনের দীর্ঘ লাইন। আর মাত্র কটা দিন। ২৫ জুন উদ্বোধন হবে বহু প্রতীক্ষার পদ্মা সেতু।


    পদ্মা সেতুর সম্ভাব্যতা যাচাই সমীক্ষা অনুযায়ী, গঙ্গা, যমুনা ও মেঘনা নদী অববাহিকা এলাকা বাংলাদেশ, ভারত, চীন, নেপাল ও ভুটানের প্রায় সাড়ে ১৭ লাখ বর্গকিলোমিটার এলাকাজুড়ে বিস্তৃত। তিন অববাহিকার মধ্যে সবচেয়ে বিস্তৃত গঙ্গা বা পদ্মা অববাহিকা—প্রায় ১১ লাখ বর্গকিলোমিটার। এই অববাহিকার সিংহভাগই পড়েছে ভারত ও নেপালে। বাংলাদেশে পড়েছে মাত্র ৪ শতাংশ।


    ভারতে যেটি গঙ্গা, সেটির নাম বাংলাদেশ অংশে পদ্মা। এটি গঙ্গার প্রধান ধারা। গঙ্গার উৎপত্তি হিমালয়ের গঙ্গোত্রী হিমবাহ থেকে, যা সমুদ্র থেকে প্রায় ৭ হাজার মিটার উঁচুতে। উৎপত্তির পর নদীটি ২ হাজার ৫২০ কিলোমিটার পাড়ি দিয়ে বঙ্গোপসাগরে মিশেছে। গঙ্গা নদী বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা দিয়ে। সেখান থেকেই নদীটির নাম হয় পদ্মা। বাংলাদেশে প্রবেশ করে এটি রাজশাহী, পাবনা, কুষ্টিয়া, রাজবাড়ী হয়ে পৌঁছায় গোয়ালন্দ-দৌলতদিয়া-আরিচা পর্যন্ত। দৌলতদিয়ায় পদ্মা ও যমুনা মিলিত হয়।


    নদীবিজ্ঞানীরা যমুনাকে বলেন ব্রহ্মপুত্র। তাঁদের কাছে গঙ্গা ও ব্রহ্মপুত্রের মিলিত নাম পদ্মা। এরপর পদ্মা-যমুনার মিলিত ধারা চাঁদপুরের কাছে মেঘনার সঙ্গে মিলে মেঘনা নামে বঙ্গোপসাগরে গিয়ে মিশেছে।


    পানি উন্নয়ন বোর্ডের তথ্য অনুযায়ী, ভারতের ফারাক্কার পর থেকে দৌলতদিয়া পর্যন্ত পদ্মার দৈর্ঘ্য ১৮৫ কিলোমিটার। আর পদ্মা সেতুর সম্ভাব্যতা যাচাই সমীক্ষা অনুসারে, দৌলতদিয়া থেকে চাঁদপুর পর্যন্ত পদ্মার দৈর্ঘ্য ১০২ কিলোমিটার।


    বাংলাদেশে ঢোকার আগে গঙ্গা নদীর ওপর ভারত ১৯৭১ সালে ফারাক্কা ব্যারাজ তৈরি করে। ১৯৭৪ সাল থেকে দেশটি নদী থেকে পানি প্রত্যাহার শুরু করে। এরপর থেকেই কুষ্টিয়া, রাজশাহী ও পাবনা অংশে পদ্মা নাব্যতা হারায়।


    পদ্মা, যমুনা ও মেঘনা—এই তিনটি নদী বাংলাদেশের ভূখণ্ডকে মূল তিনটি ভাগে ভাগ করেছে। ঢাকা ঘিরে মধ্যাঞ্চল, চট্টগ্রাম ও সিলেট বিভাগ নিয়ে পূর্বাঞ্চল এবং রাজশাহী, রংপুর, খুলনা ও বরিশাল নিয়ে পশ্চিমাঞ্চল। বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর পর্যায়ক্রমে সড়ক যোগাযোগ বিস্তৃত হয়েছে। মেঘনা, মেঘনা-গোমতী, বঙ্গবন্ধু ও ভৈরব সেতু নির্মাণের ফলে মধ্য, পূর্বাঞ্চল এবং উত্তরাঞ্চলের সঙ্গে রাজধানীর সরাসরি সড়ক যোগাযোগ সম্ভব হয়। সারা দেশকে সড়ক যোগাযোগে এক সুতোয় বাঁধার কাজটি আটকে থাকে পদ্মা নদীর কারণে।


    ২০০৫ সালে করা পদ্মা সেতু প্রকল্পের সম্ভাব্যতা যাচাই সমীক্ষা অনুযায়ী, মুন্সিগঞ্জের মাওয়া দিয়ে ফেরিতে ওঠার পর পদ্মা নদী পার হতে সময় লাগে দুই ঘণ্টা। মানিকগঞ্জের পাটুরিয়া দিয়ে লাগে ৩৫ মিনিট। মাওয়া ফেরিঘাটে যাত্রীবাহী যানবাহনকে গড়ে দুই ঘণ্টা এবং পণ্যবাহী যানকে আড়াই ঘণ্টা অপেক্ষায় থাকতে হয়। অবশ্য ঈদ, বড় ছুটি অথবা শীতে ঘন কুয়াশায় ফেরিঘাটে ১৮ থেকে ২০ ঘণ্টাও অপেক্ষা করতে হয় নদী পার হতে।


    পদ্মা নদীতে প্রথম স্থাপনা লালন শাহ সেতু, যা ২০০৪ সালে চালু হয়েছে। এই সেতু পাবনার ঈশ্বরদীর সঙ্গে কুষ্টিয়ার ভেড়ামারা উপজেলার সংযোগ স্থাপন করেছে। মূলত বঙ্গবন্ধু সেতুর ব্যবহার বাড়াতেই সেতুটি নির্মাণ করা হয়।


    পদ্মা সেতু চালু হলে এটি হবে বাংলাদেশের দীর্ঘতম সেতু। মূল সেতুর দৈর্ঘ্য ৬ দশমিক ১৫ কিলোমিটার। দ্বিতীয় দীর্ঘতম বঙ্গবন্ধু সেতুর দৈর্ঘ্য ৪ দশমিক ৮ কিলোমিটার। দৈর্ঘ্যের দিক দিয়ে তৃতীয় লালন শাহ সেতু। দৈর্ঘ্য প্রায় ১ দশমিক ৭৯ কিলোমিটার।


    নদী বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক আইনুন নিশাত প্রথম আলোকে বলেন, ভরা বর্ষায় পদ্মা নদীর পানির প্রবাহ প্রতি সেকেন্ডে ৪ থেকে সাড়ে ৪ মিটার। পদ্মা সেতু প্রকল্পে কাজ করা বিদেশি বিশেষজ্ঞরা এত স্রোতের বিষয়টি বিশ্বাসই করতেন না। কারণ, সাধারণত পাহাড়ি নদীতে স্রোত বেশি থাকে। কিন্তু সমুদ্রে মিশে যাওয়ার আগের অবস্থানে পদ্মায় এত স্রোত অকল্পনীয়। এ ধরনের অবস্থায় পৃথিবীতে একমাত্র আমাজনই এর চেয়ে বেশি খরস্রোতা।


    ব্রহ্মপুত্র সিরাজগঞ্জে ১৪ কিলোমিটার চওড়া। রাজশাহীর দিকে পদ্মা ৬ কিলোমিটার। এরকম দুটি মিলিত ধারা মাওয়ার কাছে ৩ কিলোমিটার চওড়া এলাকা দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে—এ কথা জানিয়ে আইনুন নিশাত বলেন, পদ্মা সেতু যেখানে নির্মিত হয়েছে, সেখানে মূল বর্ষায় নদীর গভীরতা দাঁড়ায় প্রায় ৬০ মিটার। বর্ষাকালে পদ্মা সেতুর কাজে ব্যবহৃত বড় ক্রেন, বার্জ ও ড্রেজার থর থর করে কাঁপতে দেখা গেছে। সব মিলিয়ে বলা যায়, পদ্মা ভয়ংকর ও শক্তিশালী নদী। এর ওপরই পদ্মা সেতু নির্মিত হয়েছে। 

    লিখাঃ আনোয়ার হোসেন, ঢাকা

    সংগৃহীতঃ প্রথম আলো অনলাইন থেকে।

    স্বত্ব সংরক্ষিতঃ প্রথম আলো অনলাইন

    *

    Post a Comment (0)
    Previous Post Next Post